গাফফার ভাই সুস্থ থাকুন, ভালাে থাকন। শিতাংশু গুহ,             

 ৩১শে জানুয়ারি ২০২২।

                বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান’র ওপর মৌলবাদীদের আক্রমনের পর তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন যে, মাদ্রাসা থেকে তার ওপরে আক্রমন হয়েছে, তিনি তাই মাদ্রাসাগুলাে বন্ধ করে  দেয়ার দাবি করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে নিউইয়র্কে এক সভায় আমি কবি শামসুর রাহমানের বরাত দিয়ে বলেছিলাম, শামসুর রাহমান দাবি করেছেন যে দেশের মাদ্রাসাগুলাে বন্ধ করে দেয়া উচিত’। পরদিন নিউইয়র্কের একটি সাপ্তাহিক ব্যানার হেডিং করে যে,   ‘শিতাংশু গুহ বাংলাদেশের মাদ্রাসা ও মসজিদগুলাে বন্ধ করার দাবি করেছেন। ব্যস, আর যায় কোথা, চারিদিক থেকে শিতাংশু’র চোদ্ধ গােষ্ঠা উদ্ধার শুরু হয়, চলে তিনমাস। তখন নিউইয়র্কে হাতেগােনা কয়েকটি সাপ্তাহিক, কেউ কেউ আমার বিপক্ষে, এবং ” ১/২Iট আমার পক্ষে অবস্থান নেয়। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ম পরিষদের প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, এঁরা আমার পক্ষ নেয়। নিউইয়র্কে তখন এনিয়ে রীতিমত যুদ্ধ চলছিলাে, তবে তা হিন্দু-মুসলিম রূপ নেয়নি, বরং তা ছিলাে প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ফাইট। ঐসময় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আমি বলেছিলাম, আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযােগ যদি বাংলাদেশে উঠতাে, তাহলে এতক্ষনে আমার বাড়ীঘর আগুনে পুড়ে ছাই হতাে। তখনকার যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল ইসলাম অনু আমায় বলেছিলেন, ‘শিতাংশু, আপনি রাজনীতি করেন, পক্ষে-বিপক্ষে যাই হােক, বিনে পয়সায় এত প্রচারণা পাচ্ছেন তাইবা কম কি?’ 

 

প্রায় সিঁকি শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা উল্লেখ করার কারণ হচেছ, ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকে ৩০শে জানুয়ারি ২০২২ প্রকাশিত মতামত সেকশনে প্রখ্যাত কলামিষ্ট, একুশের গানের রচয়িতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’র ঘনিষ্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী’র সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ’ শীর্ষক কলামে আমার নাম উল্লেখ করেছেন ।

https://www.ittefaq.com.bd/312434)। অতীতে আরাে দ’চারবার তাঁর কলামে আমার নাম এসেছে সেটি পক্ষে, এবার বিপক্ষে। শ্রদ্ধেয় গাফফার চৌধুরী’র কলামের জবাব দেয়ার ধৃষ্টতা বা যােগ্যতা আমার নেই, তবে আমার অবস্থান পরিষ্কার করার জন্যে এ লেখা। প্রথমত  অনুভাই’র কথা স্মরণ করে বলা যায় প্রচারণা পক্ষে-বিপক্ষে যাই হােক,মন্দ কি? ওপরের দৃষ্টান্ত দিয়ে তা বলা যায়, অনেকের মত গাফফার চৌধুরী মিথ্যা প্রচারণায় বিশ্বাস থাকন।শিতাংশু গুহ, ৩১শে জানুয়ারি ২০২২। করেছেন। নিজের স্বপক্ষে কথা বলার আগে, এ কলামটি নিয়ে   আমার মন্তব্য হচ্ছে, গাফফারভাই সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে সা”সামাজিক বিপ্লবের ইঙ্গিত করেছেন? দেশে এখন সেই সুযােগ আর _ নাই, শুভবুদ্ধি সম্পন্নবুদ্ধিজীবীরা যখন তােষামােদে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন সেই সুযােগ হাতছাড়া হয়ে যায়, তাই গেছে।  এজন্যে পাঠ্য বইয়ে মৌলবাদ তকে পড়েছে, রাষ্ট্রধর্ম পাকাপােক্ত হয়েগেছে। এখনাে প্রতিদিন হিন্দরা  দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। ২০০১ বা রামু থেকে কুমিল্লা কোন ঘটনার বিচার হয়নি। অর্ধ-শতাব্দীতে দেশে হাজারাে স্মৃতি ভাঙ্গা হয়েছে, আজ  পর্যন্ত একজনের বিচার হয়নি। মুখে  * সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র মিথ্যা  আশ্বাস দেয়া হলেও তলে তলে বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করার  প্রক্রিয়া চলছে। আর এসবই হচ্ছে,সরকার, গাফফার চৌধুরী বা তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের  নাগের ডগায়, তাঁরা সবই জানেন, বােঝেন, কিন্তু চুপ থাকতে পছন্দ , করেন!

  এবার আমার প্রসঙ্গ। গাফফার( চৌধুরী প্রায় সরাসরি বলে দিয়েছেন। শাতাংশু বিজোপ করে’। সম্ভবত:  ২০০৩-এ তিনি নিউইয়র্কে  বলেছিলেন, ‘ঐক্য পরিষদে বিজেপি’র উৎপাত রয়েছে’, তখন আমি এর লক্ষ্য ছিলাম না? অনেকের মত গাফফার চৌধুরী ঐক্য পরিষদ পছন্দ করেননা, যদিও আমরা তাঁকে দু’তিনবার নিউইয়র্কে এনেছিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে, আমার কে বিজেপি করার দরকার আছে? আমি ভারতীয় নই, ভারত আমার দেশ নয়, আমি বাংলাদেশী। গাফফার ভাইকে ধন্যবাদ, তিনি লিখেছেন যে আমি বাংলাদেশী, অনেকেই তাে আজকাল পারলে ভারতের দিকে ঠেলে দেন? যেহেতু আমি ভারতীয় নই, তাই আমার বিজেপি করার প্রয়ােজন নেই। গাফফারভাই, বা আমাদের প্রগতিশীলরা, বা প্রশাসন আকারে-ইঙ্গিতে আমাদের বলার চেষ্টা করেন যে, সংখ্যালঘু সমস্যা নিয়ে তােমার আমেরিকা-ইউরােপে সরকারে দ্বারস্থ হও ক্ষতি নাই, ভারতের কাছে বিচার চাহিও না’। একাত্তরে একথা মনে ছিলােনা? আমাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরােপ বা ভারত সবই বিদেশ, আমরা সবার কাছেই সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান চাই? কারণ, বাংলাদেশে কোন সরকারই সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান দিচেছনা। এখন আসি, বিজেপি কেন? যুক্তরাষ্ট্রে আমরা প্রশাসনের সাথে দেখা করি, ডেমােক্রেট বা রিপাবলিকান প্রশাসন নয়, যখন যেদল ক্ষমতায় থাকে তাদের প্রশাসনের সাথেই দেখা করি এতে আমরা ডেমােক্রেট বা রিপাবলিকান হয়ে যাইনা। ভারতের  ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য, আমরা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেই, দলের কাছে নয়! বিজেপি এখন ক্ষমতায়, সুতরাং আমাকে অনেকের কাছে বিজেপি’ ‘বিজেপি’ মনে হয়? কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে আমরা কংগ্রেসের কাছেও ধর্ণা দিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সাথে দেখা করেছিলাম। তখন যদি আমরা কংগ্রেস না হই, তাহলে এখন বিজেপি হৈ কি করে? ২০০১’র পর আমরা ঐক্য পরিষদের পতাকাতলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম, আওয়ামী লীগ এবং প্রগতিশীল শক্তি আমাদের সমর্থন করেছিলাে। আমাদের আন্দোলন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে সহায়তা করেছে, তখন আমরা প্রগতির ধারক-বাহক’। বিএনপি আমলের মত বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন সমান তালে চলছে, তাই আমাদের আন্দোলনওঅব্যাহত রয়েছে। আমরা যেমন ছিলাম, তেমনি আছি, একই  আন্দোলন করছি, সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ করছি। গাফফার আগে আমাদের সাথে ছিলেন, এখন নেই, কারণ সরকার নাখােশ হবে। আমার প্রশ্ন, আমি তাে একই কাজ করছি, সেটি হচ্ছে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ, আমি একদা প্রগতির ধারক-বাহক থাকলেও হটাৎ বিজেপি হয়ে যাচ্ছি কেন? আমাকে থামাতে চেষ্টা না করে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ হলেই তাে আমি থেমে যাই?

 

গাফফার চৌধুরী পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রসঙ্গ আমার ধারণা, বাংলাদেশে ১৬কোটি মানুষের মধ্যে ১৪কোটি মমতা ব্যানার্জীকে সাপাের্ট  করেছিলাে, বাকি দুই কোটি বিজেপি। এই প্রবাসে বাংলাদেশের বেশিরভাগ হিন্দু ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলাে, সংখ্যাগুরুরা বাইডেনকে। দেশের একটি বড় পত্রিকা আমায় তখন এর কারণজিজ্ঞাসা করেছিলাে, আমার উত্তর ছিলাে, এতে রাজনীতি নেই, যেহেতু দেশে আপনারা আমাদের অত্যাচার করেন, এজন্যে হিন্দুরা আপনাদের  অবস্থানের বিপক্ষে মাত্র’। মমতা  ব্যানার্জির জন্যেও একই কথা প্রযােজ্য। তবে পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু কংগ্রেস-বামদল-তৃণমূল কখনাে  প্রশাসন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর পক্ষে , একটি শব্দ ব্যয় করেনি, তাই  হিন্দুদের আশা ছিলাে, বিজেপি জিতলে তাঁরা কথা বলবে এবং  পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন আলােচনায় উঠলে, বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে, আশা ছিলাে হয়তাে তাতে নির্যাতন কমবে।  গাফফারভাই ভারতে মুসলিম নিধন(!) কোথায় দেখলেন কে জানে? সমস্যাটা সেখানেই, ভারতে দু’একটিঘটনা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি  এড়ায় না, সেই প্রসঙ্গ টানতেও ছিলাম দেরি করেননা, কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন তাঁরা দেখতে পান-না?  ভারতে মুসলমানের বাড়িঘর হিন্দুরা দখল করেনা, ধর্মের কারণে মুসলিম ধরীরা নারী ধর্ষিতা বা ধর্মান্তরিত হয়না, যাবাংলাদেশে একটি দৈনন্দিন ঘটনা? ভারতে রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, শাল্লা বা রংপুরের মত ঘটনা ঘটে না? ভারতে মুসলিমদের পক্ষে যেভাবে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা রাস্তায় নামেন, বাংলাদেশে কি তা চিন্তা করা যায়? দ্রষ্টব্য যে, ভারতে প্রতিটি ঘটনার বিচার হয়, বাংলাদেশে হয়না। ভারতে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে শুধু বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার নজির বারবার টানা হয়, আর বাংলাদেশে এমন একটি বড় মন্দির নেই, যা গত পঞ্চাশ বছরে কখনাে না কখনাে। আক্রান্ত হয়নি। মাত্র ৭কোটি টাকার জন্যে রমনা-কালীবাড়ি পুন প্রতিষ্ঠায় আমাদের ভারতের কাছে হাত পাততে হয়? এইতাে  সম্প্রীতি, চমৎকার সম্প্রীতি। দুঃখ লাগে, গাফফার ভাইয়ের লেখায়,  ‘ব্লেম ভিকটিম সিনড্রোম’ স্পষ্ট। দেশে সর্বত্র এই সিনড্রোম অস্পষ্ট । নয়? এটিই আজকের বঙ্গবন্ধু’র বাংলাদেশ! গাফফার ভাইকে প্রশ্ন : করতে ইচ্ছে হয়, মমতা ব্যানার্জি যেভাবে সংখ্যালঘু’র পক্ষে অবস্থান  নেন, বাংলাদেশে কি এমন একজনও আছেন? সামান্য একজন শিতাংশু’র বিরুদ্ধে আবদুল গাফফার চৌধুরী হটাৎ কিছু লিখে ফেলেছেন বিষয়টি তা হয়তাে তা নয়, এর একটি সুদূর প্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে, হয়তাে এটি পরিকল্পিত এবং হয়তাে এর উদ্দেশ্য মহৎ নয়। সম্প্রতি কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যত্র সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বড়সড় of-1940/ আন্দোলন গড়ে উঠেছে, বিজেপি কানেকশন আনতে পারলে হয়তাে ।এটিকে অন্যদিকে ধাবিত করা সম্ভব। গাফফারভাই হয়তাে আমাদের আন্দোলনে বিজেপি সংযােগ আবিষ্কার করে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুর্বল করতে চাইছেন কিনা কেজানে? যদি তাই হয়, তাহলে অনেকের মত তিনিও একটি বড় ভল করবেন। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌম চেতনায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ পথে হাঁটছে, যা কাম্য নয়। আমরা সরকার পতনের আন্দোলন ৮ করিনা, সরকারকে সঠিক পথে রাখার জন্যে সংগ্রাম করি। আমরা  হারলে গাফফার চৌধুরী হারবেন, সরকার বা প্রগতিশীল শক্তি হারবে।গাফফার চৌধুরী আরাে একটি কথা বলেছেন যে, ভারতে কোন ঘটনা ঘটলে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়া স্বাভাবিক। এই কথাটি অধিকাংশ  ‘আঁতেল’ বলে থাকেন। তাঁরা যেটি বুঝতে চাননা তা হচ্ছে, বাংলাদেশে এ যাবৎ যা ঘটেছে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভারতে ঘটলে কিহবে? আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা নুতন কিছু নয়, অধুনা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ইসলাম অবমাননার ভুয়া অভিযােগে অনেক  হিন্দু ছেলেমেয়ে জেল খাটছে, উত্তম, টিটো বা ঝুমনের কেইসের মতআমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগও ভুয়া, উদ্দেশ্যপ্রণােদিত।  সবশেষে বলবাে, বর্তমান সরকারের আমলে আমরা যেমন সংখ্যালঘ নির্যাতন আশা করিনি তেমনি গাফফার চৌধুরীর কাছে এমন কলাম আশা করিনি আমরা আবার আশাহত হলাম। শেষ করবাে .একথা বলে যে, গাফফার ভাই সুস্থ থাকুন, ভালাে থাকুন। জয়বাংলা। 

guhasb@gmail.com;

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *