জগন্নাথ হল: বিচিত চিন্তা-ভাবনা

                                                                            -অধ্যাপক ড. দূর্গাদাস ভট্টাচার্য ১

বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটে। একদিকে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চার করে অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্ররােচনায় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র গড়ার তৎপরতা শুরু হয়। জমিদার ও নবাবদের সহযােগিতায় উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি সংগঠিত হতে থাকে। ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনকে দমনের জন্যে ব্রটিশ সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আরও শক্তিশালী করতে থাকে। তার জন্যে ব্রটিশ সরকার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্রটিশ সরকারের বিভাজন নীতির আওতায় ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার অখণ্ড বাংলাকে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দ্বি-খন্ডিত করে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রণােদনা পায়। সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী প্রগতিশীল শক্তি সাম্প্রদায়িকতা কেন্দ্রানুগ বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরােধীতা করে। এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কিয়দংশ পৃথক পৃথক ভাবে আন্দোলন চালাতে থাকে। এর ফলে সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশে এক নতুন মাত্রা যােগ হয়। বঙ্গভঙ্গ আদেশ রদ করার প্রয়াশে এ অঞ্চলে তীব্র আন্দোলন হয়। অবিভক্ত ভারতের প্রগতিশীল শক্তি এ আন্দোলনকে বেগবান করে। প্রচণ্ড চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গের আদেশ রদ করে। বঙ্গভঙ্গ আদেশ রদের বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। সে সময় তাদেরকে বুঝাবার জন্য লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফর করেন। নবাব ও বিত্তবান মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয় যে, মুসলিমদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার অভাবের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা সমূহের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হচ্ছে না। এ চিন্তাভাবনার আলােকে এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি উত্থাপন করা হয়। সে সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং এ কে ফজলুল হক ভাইসরয়-এর সঙ্গে দেখা করেন। ভাইসরয়-এর নিকট তারা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি উত্থাপন করেন। এ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দবে প্রয়াসে ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের সিদ্ধান্ত অনুমােদন করেন।

১৯১২ সালের ২৭ মে তদানীন্তন বঙ্গ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণ পরিকল্পনা প্রস্তুতির জন্য নাথান কমিশন গঠন করে। এ কমিশনের ১৩ জন সদস্য ছিল। কমিশনের মুসলিম সদস্য ছিলেন নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, আলীগড়ের মহম্মদ আলী ও আবু নাসের মােহামদ ওয়াহেদ। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে আনন্দ চন্দ্র রায়, রাসবিহারী ঘােষ, সতিশ চন্দ্র আচার্য, ললিত মােহন চট্টপাধ্যায় এবং অন্যান্যরা ছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরের প্রধান। সাম্প্রদায়িক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নেয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নাথান কমিশনের সদস্যদের তালিকা থেকে এটি স্পষ্ট ছিল। ঐ কমিশনে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তে একটি শিক্ষণ এবং আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয় এবং ঢাকা শহরে কর্মরত কলেজগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়। সে অনুসারে নাথান কমিটি ২৫টি বিশেষ সাবকমিটির উপদেশাবলীসহ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এই কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪৫০ একর জায়গা নির্ধারণ করে। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় এবং সরকারের আর্থিক সমস্যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া থেমে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওযার পর ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ১৯২০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অধীনে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। শিক্ষা কার্যক্রম মূলত ১৯২১ সালের ১ জুলাই শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ৩টি হল নিয়ে শুরু হয় তার মধ্যে জগন্নাথ হল অন্যতম। ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৩১৩ জন ছাত্র নিয়ে এ হলের কার্যারম্ভ হয়। প্রধানত অমুসলিম ছাত্রদের জন্য জগন্নাথ হল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ হলের প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রাধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত। কালের আবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টি শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। বিগত একশ বছরের ইতিহাসে জগন্নাথ হল থেকে বহু কৃতি সন্তান দেশে ও বিদেশে গৌরবময় স্থান অধিকার করে দেশ ও জাতির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।

সাবেক প্রাধ্যক্ষ, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলােকে নিছক হােস্টেল হিসেবে বিবেচনা করা যুক্তিযুক্ত নয়। উপমহাদেশের শিক্ষা জগতের অনেকেই হলগুলােকে হােস্টেল বা ডরমেটরি হিসেবে বিচার-বিবেচনা করেন। বাস্তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলাে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালের কলেজগুলাের আদলে স্থাপন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনে হলগুলােকে কলেজের মর্যাদা দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি হলে আবাসস্থল, গ্রন্থাগার, সভাকক্ষ, খাবার ঘর, উপাসনালয়, বাগান ও খেলাধুলার সুবিধাসমূহ বিদ্যমান। প্রত্যেকটি হল এমনভাবে সাজানাে হয় যাতে করে শিক্ষার্থীদের পক্ষে পরিপূর্ণ জীবন বিকাশে সহায়তা হয়। জগন্নাথ হলই একমাত্র হল যেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের একত্রে থাকার সুযােগ রয়েছে। সৃষ্টিলগ্ন থেকে জগন্নাথ হল একটি ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষায়তন । সৃষ্টির শুরু থেকে এ হলে আন্ত:ধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়। অমুসলমান বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রদের একত্রে সহাবস্থানের ফলে উহা আন্ত:সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লালন ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়। জগন্নাথ হল দীর্ঘ একশত বছর ধরে তার গৌরবােজ্জ্বল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধারা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে।

জগন্নাথ হলের প্রারম্ভিক পর্যায়ে (১৯২১-১৯৪৭) যে সমস্ত দিকপাল প্রভােষ্ট হিসেবে প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, অধ্যাপক ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, অধ্যাপক ড. নগেন্দ্র নাথ ঘােষ ও অধ্যাপক ড. হরিদাস ভট্টাচার্য অন্যতম। এঁরা সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে জ্ঞান তাপস হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষ করে আইনের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত, ইতিহাসের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার এবং দর্শনের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. হরিদাস ভট্টাচার্য অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান তাপসদের মধ্যে তারা অন্যতম। তারা প্রাত:স্মরণীয়।

কালের আবর্তে জগন্নাথ হল বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার জগন্নাথ হলের কম্পাউণ্ডটি সরকারের দখলে নেয়। উহার একটি ভবন সামরিক ব্যারাক এবং অন্য একটি হাসপাতালের সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাজনের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা তীব্র আকার ধারণ করে। এসময় বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন বােস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ঐ সময়ে জগন্নাথ হলের দক্ষিন ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন (রেজিস্ট্রার অফিস) অফিস স্থাপন করা হয়। একইভাবে পাকিস্তান সরকার জগন্নাথ হলের দক্ষিণ-পূর্ব ভবন প্রাদেশিক সংসদ ভবনে রূপান্তর করে। পাকিস্তানী শাসন আমলের প্রাথমিক অবস্থা থেকে জগন্নাথ হল শাসক শ্রেণীর রােষাণলে পতিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক বছরের মধ্যে জগন্নাথ হল তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ঢাকা হলের সংগে সংযুক্ত হয় (আগস্ট ১৮, ১৯৪৮ – জুন ৩০, ১৯৫৭)। এ সময়টি ছিল জগন্নাথ হলের শতবর্ষ পরিক্রমায় সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন অন্ধকারময় দর্শক।

পাকিস্তানী শাসন আমলে ধর্মভিত্তিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কারণে জগন্নাথ হল ও তার ছাত্ররা বিশেষভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ধর্মান্ধ মৌলবাদী চিন্তা-চেতনা অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়।একারণে বহু মেধাবী ও কৃতি ছাত্র জীবন ও জীবিকার সন্ধানে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য জগন্নাথ হলের ছাত্র ও শিক্ষকের নিরলস সংগ্রাম করা ছারা কোন বিকল্প ছিল না। ইতােমধ্যে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের চেতনাকে বেগবান করে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রগতিশীল শক্তিসমূহ সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। এরই ক্রমধারায় ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় ঘটে এবং যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সংগে জগন্নাথ হলের স্ব-অবস্থানে ফিরে আসার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অবশেষে ১৯৫৭ সালের ১ জুলাই জগন্নাথ হল তার স্ব-অবস্থান ফিরে পায়। সে সময় প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক ড. গােবিন্দ চন্দ্র দেব। তিনি ১ এপ্রিল ১৯৭০ পর্যন্ত প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন

করেন।

জাতির মহাসংকটময় মূহুর্তে ২০ এপ্রিল ১৯৭০ সালে সুসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে বিশেষ কিছু ঘটনা আজও অজানা ইতিহাসের অংশ বিশেষ। সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লেখকের সঙ্গে অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার আলােচনা হয়। সেসময়ে গণআন্দোলনের মাত্রা এতাে অধিক ছিল যে, বাংলাদেশের মানুষের বিপক্ষে পাকিস্তান সরকার কিছু করতে পারে তা অভাবিত ছিল। তাছাড়া লেখক সহ অনেকেরই বিশ্বজনমত ও বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ছিল। সেসময়ে অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, এ মুহূর্তে ছাত্র, শিক্ষক,

কর্মচারী সকলের ঢাকা ত্যাগ করা উচিত। কারণ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ব্যক্তিকেও জীবিত থাকতে দেবে না। তিনি আরও বলেছিলেন যে, কি মাত্রায় পাকিস্তান বাহিনী নির্মম হতে পারে তা মানুষের পক্ষে চিন্তা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেছিলেন সশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের পক্ষে প্রতিরােধ গড়ে তােলা সম্ভব নয়। এক পর্যায়ে তাকে বলা হলাে তিনি পরিবারসহ ঢাকা ত্যাগ করছেন না কেন? তার উত্তরে অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা বলেছিলেন তাঁর উপর প্রাধ্যক্ষের গুরুদায়িত্ব । সেকারণে তাঁর পক্ষে পলায়ন করা শােভন নয়। নৈতিকতার দৃষ্টিকোণেও তা অনভিপ্রেত। তিনি পলায়ন করলে যারা থেকে যাবে তাদের নৈতিক মনােবল ভেঙ্গে পড়বে। তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কেউ থাকবে না। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেদিন ড. গুহঠাকুরতা তার আবাসস্থল থেকে তিনি পালিয়ে যাননি। একইভাবে তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আশংকা করেছিলেন যে জগন্নাথ হলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবিগণ পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম আঘাতের শিকার হতে পারে। তা তিনি তার ঢাকা ত্যাগের পূর্বে লেখককে বিশেষভাবে বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক অধ্যাপক ও ছাত্রদের প্রতি সরকারের বিশেষ আক্রোশ রয়েছে। তাদের যথাসম্ভব সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত। উল্লেখ্য যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মধ্যে অত্যন্ত নীবিড় সম্পর্ক ছিল।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে জগন্নাথ হল পরিবার বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একমাত্র জগন্নাথ হলের তিন জন প্রাধ্যক্ষ পাক-বাহীনির হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। বাংলাদেশে একটি হলের তিনজন প্রাধ্যক্ষ শহীদ হওয়ার নজির আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। যে সমস্ত শিক্ষকদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য অন্যতম। তার স্মৃতি আজও সকলের হৃদয়ে দেদীপ্যমান। ২৫ মার্চ রাত আটটা পর্যন্ত লেখকের তদানীন্তন জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক ড. আজাদ ও অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য-র সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবে আলাপ-আলােচনা হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নের জন্য ঢাকা ত্যাগ করার কথা ছিল। ২৫ মার্চ তার দেশের বাড়ীতে থাকার কথা কিন্তু বিভিন্ন কারণে তার বাড়ী যাওয়া আর হয়ে উঠেনি। সেদিন তিনি জগন্নাথ হলে অবস্থান করছিলেন। সে কালরাত্রে পাক-বাহিনী জগন্নাথ হলের ৫ জন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন কর্মচারীসহ জগন্নাথ হলে থাকা অন্যান্যর সংগে অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সে কালরাত্রে অন্যান্যদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কৃতী ছাত্র এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা মৃণাল কান্তি বােসকে পাক-বাহিনী হত্যা করে। তার সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল এবং সুসম্পর্ক ছিল। লেখক ব্যক্তিগতভাবে বার বার তাকে বাড়ী যাওয়ার জন্য উপদেশ দেয়। তার মধ্যে বিশেষ একটি চেতনা কাজ করে। তাকে যতবার বলা হয়েছে, অসম যুদ্ধে প্রাণ দেওয়ার চেয়ে পালিয়ে যাওয়া অধিকতর শ্রেয়। তাঁর চিন্তা ছিল হলে পাক-বাহিনীকে সর্ব শক্তি দিয়ে মােকাবেলা করবেন। পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তার কাছে গ্রহণযােগ্য ছিলনা বিধায় সে রাতেই তাঁকে আত্মাহুতি দিতে হয়। এ সম্ভাবনাময় যুবকের আত্মাহুতির বিষয়টি কেউ মেনে নিতে পারেনি।

জগন্নাথ হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অজয় কুমার রায়ের মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা পালনকারী বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর নাম

গ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহু প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে। তবে একজনের মধ্যে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবী, ইতিহাসবিদ ও মানবাধিকারকর্মীর গুণাবলীর সমাবেশ সমাজে বিরল। তিনি নিজে ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু ধর্মীয় স্বাধীনতায় তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন একজনের যেমন বিশেষ ধর্মে বিশ্বাস করার অধিকার আছে তেমনি প্রতিটি মানুষের কোন ধর্মে বিশ্বাস না করারও অধিকার আছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় তার সুযােগ্য সন্তান অভিজিৎ রায় তাঁর চোখের সামনে মৌলবাদীদের দ্বারা নিহত হন। ড. অজয় রায়ের মত একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অনন্য সাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তি জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ’র পদটি অলংকৃত করে জগন্নাথ হলের ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যােগ করেছেন। ১৯৭০ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমিতির এক সভায় তিনি পূর্ব বাংলা” শব্দদ্বয় উচ্চারণ করেছিলেন বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনৈক শিক্ষক তাঁকে আক্রমন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঐ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক পাকিস্তান সরকারকে সহযােগিতা করেছেন। তিনি পাকিস্তানপন্থী শিক্ষক-দল থেকে শিক্ষক সমিতিতে নির্বাচনও করেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য সে ব্যক্তিটি বিশেষ মহলের সমর্থনে ক্ষমতাসীন দলের প্রথম কাতারে এসে যান এবং একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সর্বোচ্চ পদে আসীন হন। এরাই ধিরে ধিরে

2 নিহত সকল কর্মচারী হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল।

সাপ্রদায়িকতার ধারাকে বেগবান করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অধ্যাপক ড. অজয় রায় শিক্ষক সমাজকে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে সমস্ত শিক্ষকদের সুসংগঠিত করেছেন এবং বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারই অনুপ্রেরণায় লেখক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন কার্যে অংশগ্রহণ করেন। তারই নির্দেশে এবং অধ্যাপক ড. সারােয়ার মােরশেদের উপদেশে লেখক প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের অধীনে রিফিউজি রিটার্ন এন্ড রিসেটেলমেন্ট প্রজেক্টে এ্যাডমিনিস্ট্রেটর কাম একাউন্স অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ প্রজেক্টেটের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন প্রফেসর ড. এ. আর, মল্লিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই এই প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাছাড়া লেখক প্রবাসে প্রকাশিত ‘দি পিপল’ পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে সংবাদ বিশ্লেষণে সহায়তা করে। অধ্যাপক ড. অজয় রায় প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামীকে অনুপ্রেরণা দেন, সাহস দেন এবং তাদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করেন। মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্তির পর নির্যাতিত মহিলাদের পাশে থেকে তিনি তাদের পুনর্বাসনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তিনি মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালের সহযােগিতাক্রমে বহু নির্যাতিত নারীর পূনর্বাসনে সহায়তা করেন। অধিকাংশ কাজই তিনি নিরবে নিভৃতে করে যেতেন। তার কাজের প্রচারণা একেবারেই ছিল না। লেখক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে লক্ষ্য করেছেন যে, ড. অজয় রায় দিনরাত বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য সক্রিয় ছিলেন। সে কারণে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি তাকে কোন দিনই গ্রহণ করতে পারেনি। তিনি আদর্শের সঙ্গে ব্যক্তিগত লাভের জন্য কোন অশুভ শক্তির কাছে কোনদিন আপােষ করেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি একজন নির্ভীক সৈনিক এবং মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক ছিলেন। প্রাধ্যক্ষ হিসেবে জগন্নাথ হলের সঙ্গে তার সম্পৃক্তি জগন্নাথ হলের গৌরবময় ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যােগ করেছে।

স্বাধীনতা-উত্তর কালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে অবস্থার উন্নতি হলেও পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক মনমানসিকতা বিস্তার ঘটার জন্য জগন্নাথ হল অবজ্ঞা ও অবহেলার শিকার হয়। এরই ক্রমধারায় ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর আনুমানিক রাত সাড়ে আটটায় জগন্নাথ হলের পরিষদ ভবন (এ্যাসেম্বলী হল) ধ্বসে পড়ে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ দুর্ঘটনায় ৪০ জন মৃত্যু বরণ করেন এবং দু’শতের অধিক ছাত্র, কর্মচারী ও অতিথি আহত হয়। এ্যাসেম্বলী হল ধ্বসে পড়ার দুর্ঘটনা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ক্রমযােজিত অবহেলা ও অবজ্ঞার প্রসূন। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার পর থেকে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের ধর্ম ভিত্তিক বৈষম্যের ধারা বেগবান হতে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষক রাজনীতি প্রগতিশীল মনে হলেও তার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা ধর্মান্ধতা বিশেষভাবে তৎপর থাকায় জগন্নাথ হল বৈষম্যের শিকার হয়। বিভিন্ন সময়ে তদানীন্তন প্রাধ্যক্ষগণ কর্তৃপক্ষের নিকট জগন্নাথ হলের ভবনগুলাের সংস্কারের আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনের প্রেক্ষিতে ভবন সংস্কারের জন্য কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। যতদূর জানা যায় সাবেক প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রবীন্দ্র নাথ ঘােষ ঠাকুর তাঁর পত্রে উল্লেখ্য করেছিলেন যে, এ্যাসেম্বলী ভবনের তাৎক্ষণিক মেরামত না হলে ভবনটি ভেঙ্গে পড়ে যে কোন সময় জীবনপাত ঘটাতে পারে। সেই সময় অন্যান্য ভবনগুলাের অবস্তাও জরাজীর্ণ ছিল। জগন্নাথ হলে সংস্কার বিষয়ে যে জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়ােজন ছিল তা নেওয়া হয়নি। সে সময়কার অবস্থার বর্ণনা দিতে যেয়ে প্রয়াত প্রথিতযশা শিল্পী ফকির আলমগীরের পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেছেন, স্থবিরতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে ওরা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, জীর্ণ ছাদ কিংবা দালানের মতােই সমাজ জীর্ণ এবং অকেজো। তাই, জীর্ণ সমাজকে না ভাঙলে অমনি অবহেলায় প্রাণ দিতে হবে আরও অনেক সম্ভাবনাময় তরুণকে। এর মধ্যে অনেক সময় গড়িয়েছে, সরকারের বদল হয়েছে, কিন্তু বদলায়নি সমাজ ব্যবস্থা। জীর্ণ সমাজের হাত ধরে এসেছে সন্ত্রাস। সন্ত্রাসের কারণেও প্রাণ দিতে হচ্ছে অনেক তরুণকে। পাল্টানাে যায়নি নিয়ম,

ত্রি-ছাত্রীদের।— সংস্কৃতি আজ অপশক্তির দ্বারা আক্রান্ত, রাজনীতি আজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে বিভেদ আর রাজনৈতিক শূণ্যতা, লক্ষ্যহীনতা- এই হচ্ছে সমাজের বাস্তব চিত্র।”

১৫ অক্টোবর দুর্ঘটনার সময় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ললিত মােহন নাথ। পরবর্তী সময়ে তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যা সমাধানে তার সংগ্রামী ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না। দুঃর্ঘটনার পরবর্তী সময়ে মানুষের আচরণে দ্বিবিধ বিপরিতমুখী প্রবণতা দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলার দায় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য কতিপয় ব্যক্তি এই দুর্ঘটনার জন্য প্রাধ্যক্ষকে দায়ী করতে থাকেন। এ দুর্যোগময় মুহূর্তে কোন কোন বাম ঘরানার বড় মাপের নেতা ও অল্প সংখ্যক শিক্ষক ড. ললিত মােহন নাথ-এর বিরুদ্ধে ছাত্র ও জনমত সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। বাম ঘরানার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বক্তব্য সে সময়কার দৈনিক পত্রিকাগুলােতে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থে প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কারও কারও প্রচেষ্টা সাধারণ মানুষকে ব্যথিত করেছে।

এ ব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিশনগুলাে দুর্ঘটনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে, জগন্নাথ হলের ১৯৮৫ সালের দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরে বাংগালী জাতি-সত্ত্বার চরম অভিব্যক্তি ঘটে। শিক্ষিত ও বিত্তবান জনগােষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ থাকলেও সাধারণ মানুষ বাংগালী জাতিয়তাবাদের চেতনা সঞ্জাত মানবিক মূল্যবােধে অঙ্গীকারবদ্ধ।

১৫ অক্টোবর, ১৯৮৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে প্রগতিশীল সমমনা শিক্ষকগােষ্ঠীর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভা শেষ হওয়ার পর বাড়ী ফেরার পথে এ দুর্ঘটনাটি জানা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে লেখকসহ অন্যান্য কয়েকজন সহকর্মী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। সে সময় আহত ছাত্রদের আর্তনাদে সকলেই মর্মাহত ও বিচলিত। কিছুক্ষণ পর ফায়ার ব্রিগেড আসে এবং ক্রেইনের মাধ্যমে। উদ্ধারকার্য রু হয়। উল্লেখ্য যে, সেদিন ঢাকার অ্যাম্বুলেন্সগুলাে এবং জরুরী বিভাগগুলাে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সে ঘটনার দিন ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে কোন ধর্ম ভিত্তিক ভেদাভেদ পরিলক্ষিত হয়নি। মানুষ মানুষের জন্যে কথাটি সেদিন বাংলাদেশের সকল স্তরের প্রতিটি বাঙালি প্রমান করেছে যে, আমরা মানুষ। শাসকশ্রেণী দলমত নির্বিশেষে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার ও প্রসার করে ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সেদিন প্রমান করেছে যে, বাংলাদেশ একটি

য়ক চেতনা-সমদ্ধ দেশ। ১৫ অক্টোবরে জাগ্রত জনতার চেতনাকে ধরে রাখা সম্ভব হলে সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ১৫ অক্টোবর মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও বাঙালি চেতনার পুনর্জাগরণ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। লেখক কয়েক জন ছাত্র নেতাকে নিয়ে সারারাত ভরে রক্ত সংগ্রহের কাজে নিয়ােজিত থাকার সময় কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা লক্ষ্য করে। সে সময় তারা লক্ষ্য করেন অন্যান্যদের সাথে আলিয়া মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র রক্তদান করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। একইভাবে বােরখা পরিহিত কয়েকজন নারী রক্তদান করার জন্য ডাক্তারদের নিকট আকুতি জানাচ্ছেন। এ ঘটনাগুলাে চোখে না দেখলে কারাে বিশ্বাস হওয়ার নয়। এ থেকে লেখক আসস্থ হয়েছিলেন যে, যতভাবে এ দেশের মানুষকে ধর্মান্ধ করার চেষ্টা করা হােক না কেন জাতির ক্রান্তিলগ্নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবিক মূল্যবােধে বাংলার মানুষ এক ও অভিন্ন।

ছাত্রসমাজকে কিভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ না হলে তা লেখকের পক্ষে কোন ভাবেই জানা সম্ভব হতাে না। ১৯৯৬ সালে ১ আগষ্ট বিশেষ এক ক্রান্তিলগ্নে লেখক জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করে। দায়িত্ব লাভের পর-পরই কিছু কিছু অস্ত্রধারী রাজনৈতিক গ্রুপের মুখােমুখি হতে হয়। তারা উপাসনালয়ে পর্যন্ত অস্ত্র লুকিয়ে রাখতাে। সন্ত্রাস দমনের জন্য যথারীতি জগন্নাথ হলের মূল ফটকে চব্বিশ ঘন্টা পুলিশ পাহারারত থাকতাে। একদিন হঠাৎ করে পূর্ব দিক থেকে একদল অস্ত্রধারী তথাকথিত ছাত্র ও বহিরাগত জগন্নাথ হল দখল করে নেয়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে দক্ষিণ গেট দিয়ে পুলিশের সামনে অন্য দল জগন্নাথ হল পুনর্দখল করে নেয়। এ অবস্থার মধ্যে প্রাধ্যক্ষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। প্রধ্যক্ষের জানা মতে, শান্তিপূর্ণভাবে প্রশাসন চালানাের জন্য দু’টো চিরন্তন ধারা প্রবহমান। একটি ধারা অস্ত্রধারী ক্ষমতাধর ছাত্রনেতাদের নির্দেশ অনুসারে চোখ-কান বন্ধ করে প্রশাসন চালানাে। এ ধারায় আবাসিক অধ্যাপকগণের কোন কর্তব্য থাকে না। ভয়ে বা ইজ্জত রক্ষায় প্রশাসন নিয়ে কেউ উচবাচ্য করে না। পত্র-পত্রিকায় কোন প্রতিবেদন ছাপা হয় না বিধায় উপাচার্য ধরে নেন হল প্রশাসনে কোন সমস্যা নেই। অন্য ধারাটি হলাে নিয়ম-নীতির কাঠামাের মধ্যে থেকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে হলকে মুক্ত করে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থে প্রশাসন পরিচালনা করা। এ জাতীয় প্রশাসনে আবাসিক শিক্ষকগণ প্রশাসনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রাধ্যক্ষ তাদের কর্মকাণ্ড সমন্বয় সাধন করে মাত্র। এ অবস্থার মধ্যে কোন ধারাটি অনুসরণীয় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুব সহজ ছিল না। তবে কোন বিবেকবান মানুষ সন্ত্রাস ও শিক্ষার সহঅবস্থান মেনে নিতে পারে না। সেকারণে প্রশাসনের দ্বিতীয় ধারাটি অনুসরণের নীতি গ্রহণ করা হয়। প্রাধ্যক্ষের উপলদ্ধি ছিল যে, কোন ছাত্রই সন্ত্রাসী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করে না। পরিবেশ এবং পরিস্থিতির কারণে তারা সন্ত্রাসীতে রূপান্তরিত হয়। এ অবস্থায় প্রাধ্যক্ষের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল কিভাবে বিভ্রান্ত কোমলমতি ছেলেদের সঠিক পথে আনায়ন করে প্রকৃত মানুষে রূপান্তর করা যায়। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল জগন্নাথ হলকে কিভাবে বহিরাগতমুক্ত করা যায়।

এ ব্যাপারে জননেত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ বিনির্মানের অঙ্গীকার ও তার কেবিনেটের শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেকের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতাসহ সন্ত্রাস দমনে নিরলস প্রচেষ্টা পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সন্ত্রাস দমনে তার সর্বাত্মক সহযােগিতা লেখকের মানসিক শক্তি যােগায়। জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে বহিরাগত অছাত্রদের প্রাধান্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাধ্যক্ষ উপলদ্ধি করেন যে, উপদেশ দ্বারা বা শাস্তির দ্বারা পরিস্থিতির পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনীয় সিষ্টেম প্রবর্তনের মাধ্যমেই এ জাতীয় পরিস্থিতি পরিবর্তন করা যেতে পারে। একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্যেখযােগ্য যে, সরকারের নৈতিক সমর্থন ও আবাসিক অধ্যাপকগণকে যথাযথ

ক্ষমতায়ন করা হলে হলের বহিরাগতদের প্রাধান্য এবং পেশী শক্তির অপ্রতিরােধ্য হিংসাত্মক কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সন্ত্রাসীর কারণে কর্মচারিগণও তাদের কর্তব্য পালন করতে পারত না। তাছাড়া তাদের দারিদ্রের সুযােগে কর্মচারীদের কেন্দ্র করে মহাজনী ব্যবসার একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। প্রশাসনিক যন্ত্রে তারা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। অসহায় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বাৎসরিক শতকরা প্রায় ১২০ ভাগ সুদে ধার নিতে হতাে। এ ব্যবসার মূলােৎপাটনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবনের প্রয়ােজন দেখা দেয়। মহাজনী সিন্ডিকেট উৎখাতের জন্য অতি অল্প হার সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য একটি অনানুষ্ঠানিক কর্মচারী কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়। এ ব্যবস্থায় যে কোন সময় কর্মচারিগণ ঋণ নিতে পারতাে। এর যাবতীয় আয় ঐ তহবিলে জমার ব্যবস্থা করা হয়। অল্প দিনের মধ্যে উহা একটি বড় তহবিলে রূপ নেয়। এভাবেই চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মহাজনী ঋণের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়। লেখাপড়া, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিভা বিকাশের জন্য জগন্নাথ হল নব্বই’র দশকে অনুপম বৈশিষ্ট সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। এ জাতীয় কাজে ছাত্রদের নেতৃত্ব যে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে পারে তা অবলােকন করে লেখক অভিভূত হয়েছে। সাধারণত হল-প্রাঙ্গণের সৌন্দর্য রক্ষায় ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী ছাত্র-নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করে না। জগন্নাথ হলের ছাত্র-নেতৃবৃন্দ ছিল তার ব্যতিক্রম। তাদের অনবদ্য ভূমিকা ছিল গঠনমূলক কাজে। প্রাধ্যক্ষ হিসেবে লেখক তার নিরব সাক্ষী। সঠিক প্রশাসন, নিবেদিত প্রাণ আবাসিক অধ্যাপক, এবং অঙ্গীকারবদ্ধ কর্মী বাহিনী দ্বারা যে অতি অল্প সময়ে ছাত্রদের চিন্তন-মননের পরিবর্তন আনা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ৯০-এর দশকের শেষ দিকের জগন্নাথ হল। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস দমনে শিক্ষকগণই যথেষ্ট যদি সরকার সন্ত্রাসীদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রণােদনা না দেয়। একথা অনস্বীকার্য যে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের মধ্যে অতীতে বহু প্রতিভাবান ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গণে অনুপম বৈশিষ্টে অধিকারী হলেও তাকে যুগযুগ ধরে অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথ হলের পরিবারের উল্লেখ্যযােগ্য অবদান থাকলেও প্রশাসন থেকে প্রয়ােজনীয় সমর্থন অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কোন কোন ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা কষ্টসাধ্য ছিল। জগন্নাথ হলের ভৌতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ অনুকূল রাখার জন্য একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরটি প্রায় সত্তর বছরের মধ্যে কোন সংস্কার হয়নি বলে এর জল সম্পূর্ণভাবে দূষিত হয়ে যায় এবং তা মশাসহ বিভিন্ন কীট-পতঙ্গের আশ্রয়স্থল হিসেবে বিরাজ করে। পরিবেশের উন্নয়নের জন্য লেখক প্রাধ্যক্ষ হিসেবে পুকুরটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু তাতে প্রশাসন থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য অনুদানসহ জগন্নাথ হলের নিজস্ব ফান্ডে এটির সংস্কার কাজ সমাপ্ত করা হয়। এ ব্যাপারে তদানীন্তন ওয়াসার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জহুরুল হক সেচযন্ত্র সরবরাহ করে সহায়তা করেন। বর্তমানে পুকুরটি জগন্নাথ হলের পরিবেশের একটি অন্যতম প্রধান অংশ। উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকারের সময় একাধিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, বঞ্চণার মাত্রা হ্রাস পেয়েছে এবং আসন সংকটের তীব্রতা নেই।

বিংশ শতাব্দীর গােড়া থেকে বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্তনিহিত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এ অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে বিস্তার করা হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার কারণে ধীরে ধীরে অমুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিক রাজনৈতিক অভিঘাত ও ইংরেজ শাসকদের বিভাজন নীতির ফলে বাংলাদেশের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিসংখ্যানে হিন্দু জনসংখ্যায় ক্রমহাসমান প্রবণতা দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির সময় এ অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা মােট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% ভাগ ছিল, ১৯৪০ সালের দিকে তা প্রায় ৩১% ভাগে নেমে আসে এবং ১৯৭১ সালের দিকে হিন্দু জনসংখ্যা মােট জনসংখ্যার ১৫% ভাগে নেমে আসে। ২০২০ সালে তা শতকরা ১০ ভাগের নিচে নেমে আসে। জগন্নাথ হলের ছাত্র-সংখ্যা মূলত হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে। অমুসলমান জনসংখ্যায় প্রবহমান ক্রমহ্রাসমান ধারা অপরিবর্তিত থাকলে অচিরেই ঐতিহাসিক জগন্নাথ হলের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে। এ সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ধর্মীয় স্বাধিনতার পুনর্ধতিষ্ঠা। ধর্মীয় স্বাধিনতা ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধুর দেয়া সংবিধানের পুনস্থাপনের সংগে সম্পৃক্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসামপ্রদায়িক সমাজ ও ধর্মীয় স্বাধিনতা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সূত্রে আবদ্ধ। প্রবহমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত জনসংখ্যার ধারা পরিবর্তন করা সম্ভব না হলে ২০৫০ সাল নাগাদ অমুসলিম ছাত্রের জন্য আর কোন পৃথক হলের কোন প্রয়ােজন থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *