সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ , 

আবদুল গাম্ফার চৌধুরী

https://www.ittefaq.com.bd/312434

 বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে দুমুখাে সাপের মতাে। সে শত্রুকে খায়, মিত্রকেও মারে। এ কথাটা যে কত সত্য, তা এখনউপমহাদেশের অবস্হা দেখে বােঝা যায়। ভারতে চলছে মুসলিম নিধন, বাংলাদেশে চলছে হিন্দু নির্যাতন। এর মাঝখানে আরাে একটি উপসর্গ দেখা দিয়েছে।

বিদেশে, বিশেষ করে বিলাতে এবং আমেরিকায় যেসব হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান আছে, তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের জন্য চলছে এক হিন্দু সম্প্রদায়ের ভুক্তভােগীরা সম্প্রতি এ ব্যাপারে বরিশাল শহরে এসে

এদিকে বাংলাদেশে সম্প্রতি বানারীপাড়া উপজেলায় হিন্দু নির্যাতনের এক নতুন খবর পাওয়া গেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের এমপি শাহ আলম সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাদের অভিযােগপত্র আমার হাতেও এসে পোঁছেছে। দুঃথিত হয়ে ভাবছি, রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, রক্ষা করিবে কে?’

নিউ ইয়র্কে যেসব সংখ্যালঘু নেতা ভারতের বিজেপির হয়ে কাজ করছেন,তারা অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। দীর্ঘদিন ধরে নানা অভাব অভিযােগের কথা সরকারকে জানিয়ে কোনাে ফল না পাওয়ায় তারা এখন ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং বিজেপি তাদের ব্যবহার করা শুরু করেছে। এর একমাত্র প্রতিকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান এবং তাদের নিরাপত্তা বিধান। তা না হলে বিদেশে সংখ্যালঘুরা বিজেপির টোপে পড়বে এবং বাংলাদেশের অবস্হা নিয়ে তার প্রতিকারের জন্য বাঁকা পথ ধরবে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কতিপয় মন্ত্রী ও এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান যেভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ করছেন এবং এখনাে তাদের জায়গাজমি দখল  করছেন, তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবসহা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরােধ জানাই। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্রমশই আওয়ামী মুসলিম লীগে পরিণত হয়েছে। একটি সাম্প্রদায়িক দল দ্বারা দেশে অসাম্প্রদায়িক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বহু বছর আগে স্বাধীনতার প্রারম্ভে প্রয়াত যুবলীগ নেতা শেখ মনি একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ

অমূল্য কথার তাত্পর্য আমরা কেউ ক, তখন বুঝতে পারিনি। বাংলাদেশের সে শাসনব্যবস্থা চার-পাঁচ হাত ঘুরেছে, কিন্তু  পরিবর্তন হয়নি। এই উপমহাদেশের অবস্হা দেখে বােঝা যায়। ভারতে চলছে মুসলিম আমলাদের দ্বারা চালিত হয়ে শেখ   হাসিনার সরকার যত কিছু দেশের  উন্নয়ন করেছেন, তার সুফল জনগণ সঠিকভাবে পাচ্ছে না।

প্রতিটি জেলা উপজেলায় যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের সেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতা ছিলেন সীতাংশু অধিকাংশই নব্য ধনী এবং ব্যবসায়ী। বাবু। তার অনুরােধে তাদের সভাযও আমি গিয়েছিলাম। এখন শুনছি নানা যও আমি গিযােছলাম। এখন শুনছি তারা নিজেদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে তারা বর্তমানে ভারতের বিজেপির হয়ে কাজ করছেন।

চলেছেন এবং তাদের একটা সহজ টার্গেট হিন্দুদের ধন-সম্পত্তি। হিন্দুদের  পজা-পার্বণে এখনাে পলিশকে প্রহরা ও তার সহযােগীরা হিন্দু সম্পত্তি দখলের জন্য হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। দিতে হয়, এটা লজ্জার কথা। সংখ্যালঘু।  সম্প্রদায়ের সব মেয়ে স্বচ্ছন্দে সর্বত্র ঘােরাফেরা করতে পারছে না, এটা আরাে লজ্জার কথা। সংখ্যালঘুদের এখন অনেক উচ্চ সরকারি পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের – সমতায়ন বাড়েনি।

 আবার বঙ্গবন্ধর কথায় ফিরে যাই।  দেশ তখন মাত্র স্বাধীন হয়েছে। আমরা  দ্বিতীয় বার দেশভাগের পরিণতি সম্পর্কে আলােচনা করছিলাম। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধ ও জিন্নাহ একবার  বলেছিলেন, সুভাষ বসু যদি কংগ্রেসের নেতা হতেন, তাহলে ভারত ভাগের  দরকার হতাে না। আপনি কি মনে  করেন, দেশ ভাগের সময় খাজা নাজিমুদ্দিনের বদলে শহীদ সােহরাওয়ার্দি যদি পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতেন, তাহলে অখণ্ড পাকিস্তান রাখা যেত? বঙ্গবন্ধ বললেন, না, রাখা যেত না। কারণ শহীদ সােহরাওয়ার্দিকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলেও ওরা বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন দাবি মানত না।

বরং শহীদ সােহরাওয়ার্দিকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করত।উপমহাদেশ যে আজ তিন ভাগে ভাগ হলাে তা রােধ করা যেত, যদি নেহরু ক্রিপস কমিশনের (স্টাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে) প্রস্তাব গ্রহণ করতেন। তার প্রস্তাবে ভারতকে জাতীয়তার ভিত্তিতে এ, বি, সি—এই তিন জোনে ভাগ করে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করার কথা ছিল জিন্নাহ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু নেহরু তা গ্রহণ করেননি।নেহরু যদি গ্রহণ করতেন, তাহলেই ভারত ফেডারেশনে হিন্দু-মুসলমান- বৌদ্ধ-থরিষ্টান সবাই সমান নাগরিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারত।পাকিস্তান তাে ধর্মরাষ্ট্র হযেছেই। নেহরু উপমহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা মেনে নিয়ে ভারতকেও একটি হিন্দু ধর্মরাষ্ট্র হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছেন। আমি হয়তাে বেঁচে থাকব না, তােমরা সেই পরিণতি দেখবে।

এটা যেন কোনাে প্রফেটের কথা। বর্ণে বর্ণে আজ মিলে গেছে। ভারতে মুসলিম দলন হলে বাংলাদেশে হিন্দু দলন হবে, এটা যেন একটা স্বাভাবিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এই প্রথা ভাঙতে চাই। হিন্দু-মুসলমানের ভেতরে জাতিভেদ ভাঙতে চাই। সবার বাঙালি পরিচযটাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চাই। বঙ্গবন্ধুর এই আশা সফল হয়নি। তাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে আবার পূর্ব পাকিস্তান করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের যেটুকু নিরাপত্তা ছিল, আজ তা-ও নেই। ওদিকে বিদেশে বসে সীতাংশুদের মতাে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি দল বাংলাদেশকে ভারতের কাছে মাথা নত করা একটি দেশ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের গত সাধারণ নির্বাচনের সময় বিদেশের এই একশ্রেণির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লােক বিজেপি যাতে পশ্চিমবঙ্গে জেতে, সেজন্য বেজায় প্রচার চালিয়েছিল।তারা আশা করেছিল, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি জিতবে এবং বাংলাদেশকে কোণঠাসা করবে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি নির্বাচনে জয়ী হওযায় তারা হতাশায় ভেঙে পড়েছে এবং এখন কিছুটা চুপচাপ। কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাগ্য বদলায়নি। বরিশালের শহরে দৌড়ে আসতে হয়েছে, তাদের অভাব-অভিযােগ জানানাের জন্য।কিন্তু সরকারি দলের এমপি সাহেব এতই শক্তিশালী যে তার কাছেসংখ্যালঘুদের অভিযােগ এক ফুযে উড়ে গেছে। শেখ হাসিনা ক্য দিক সামলাবেন? তিনি যথন দেশে ব্যাপক করােনা আক্রমণ সামলাতে ব্যস্ত,তখন তার একশ্রেণির মন্ত্রী ও এমপি ব্যস্ত লুটপাটে। উন্নয়নের ফসল যা হ্য তা নব্য ধনীদের পেটেই যায়। ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার সমাধান পর্যন্ত এখনাে করা যায়নি। মানুষকে বড় বড় উড়ালসেতু ব্যবহারে অভ্যস্ত করা যায়নি। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ খাওয়া বন্ধ করা যায়নি।ফলে যানজটের সমস্যা আগে যা ছিল, এখনাে তেমনই আছে। শেখ  হাসিনা এখন চীন ও আমেরিকার দ্বন্দ্বে জড়িত না থেকে প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক  চাপের মুখে আছেন, তা তার দল। অনুধাবন করতে পারছে কি না,সন্দেহ। তারা ‘লাস্ট ডেইজ অব পম্পের অমাত্যদের মতাে সুখনিদ্রায় । আছেন। দেশের সার্বিক পরিস্হিতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুকূল ন্য।  নিত্যই এক মহান থেকে অন্য সহানে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চলছে।

সেই সঙ্গে বাড়ছে নারী নির্যাতন। শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ব্যাপক ব্যবস্হা করেছেন। তাদের শিক্ষাব্যয় মওকুফ করেছেন। ছাত্রীদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের উচ্চপদ দিয়েছেন। কিন্তু সবই ভেসে যাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক  সমাজের পুরােনাে মনােভাব আঁকড়ে থাকার কারণে। দেশে একটি সমাজবিপ্লব প্রযােজন। রাজনৈতিক  বিপ্লবের পর সমাজবিপ্লব হ্যনি। তাই  আজ এত সমস্যা। এই অবস্থায় শুধু প্রতিবাদ না জানিয়ে বাংলাদেশ ও  পশ্চিমবঙ্গের সুশীল সমাজ কি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন না? তাদের উদ্দেশ্য হবে শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা নয়, সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। দেশে এখন ‘সম্প্রীতি  বাংলাদেশ’ নামে আন্দোলন গড়ে বানারিপাড়ার সাম্প্রদায়িক ঘটনা তার প্রমাণ। অসহায় হিন্দুদের বরিশাল উঠেছে। তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি  প্রতিষ্ঠা করবেন। নিঃসন্দেহে সেটা  ভালাে উ   ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এক কথা ন্য। আজ বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সচেতন মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে  নিজ নিজ দেশে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে। একজন মুসলমানকে রাষ্ট্রপতি করে ভারত যেমন প্রমাণ করতে পারবে না

তারা মুসলমানদের নাগরিক অধিকার দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশে শুধু  সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা নয়, সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন  শুরু করতে হবে। সেই আন্দোলনে চাই শক্তিশালী হিন্দু নেতৃত্ব। সেটা  গড়ে উঠুক। এখন সেই কামনা করি।

 (২৮ জানুয়ারি ২০২২, লন্ডন]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *