শরীয়তপুরের নড়িয়া

সিকদারদের বাগানবাড়ির জন্য ভিটেছাড়া তাঁরা শখের বাগানবাড়ি করতে ভিটেছাড়া করাহয়েছে সুমিত্রা রানীর পরিবারকে।বৈধ কাগজপত্র থাকলেও চার বছর ধরে পরিবারটি ভিটেছাড়া ।

প্রথম আলো

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

শরীয়তপুরের নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক এলাকায় জয়নুল হক সিকদারের পরিবারের বাগানবাড়ি। সম্প্রতি তােলা। ছবি: প্রথম আলাে সুমিত্রা রানীদের বয়স ৬৫| রােগশােকে জীর্ণ  সুমিত্রাকে এ বয়সে বসতভিটা ছাড়তে হয়েছে। ভাইয়ের তিন এতিম মেয়েকে নিয়ে চার বছর ধরে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের পরিত্যক্ত রান্নাঘরে। প্রভাবশালী সিকদার পরিবারের শখের বাগানবাড়ি করতে তাদের ভিটেছাড়া করা হয়েছে বলে অভিযােগ সুমিত্রা রানী পরিবারের। 

দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের ছেলে রন হক সিকদার ও রিক হক সিকদারদের এ বাগানবাড়ির অবস্থান শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক এলাকায়। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধুপুর গ্রামে। তিনি সেখানে জেডএইচ সিকদার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনােলজি বিশ্ববিদ্যালয় ও মনােয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। এর আধা কিলােমিটার দূরত্বে  নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক ও ভেদরগঞ্জের কার্তিকপুর গ্রামে অন্তত ৩০ একর জমির ওপর ২০০৯ সালে বাগানবাড়ি গড়ে তােলার কাজ শুরু  করে সিকদার পরিবার। 

স্থানীয় লােকজন বলেছেন, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে   জমি কিনে তা সীমানাপ্রাচীর দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। এরপর ভেতরে বাগানবাড়ির বিভিন্ন স্থাপনা  নির্মাণ করতে থাকেন। দুটি পুকুর, পুকুরের মধ্যে চারতলা দৃষ্টিনন্দন ভবন, ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড, হরিণের খামার, দুটি পুকুরের সংযােগস্থলে সেতু ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা লাগানাে হয়। এর মধ্যেই সুমিত্রা রানীর পৈতৃক ৪১ শতক জমি রয়েছে। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই জমির একাংশে মাল্টা ফলের বাগান, পাম্প হাউস, ভবনে প্রবেশের সেতু ও সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। আর বাড়ির কিছু অংশ দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে সুমিত্রাদের একটি ভাঙাচোরা টিনের ঘর এখনাে রয়েছে।

সিকদার পরিবারের বড় মেয়ে পারভিন হক সিকদার সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ। মুঠোফোনে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলােকে শরীয়তপুরের নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক এলাকায় জয়নুল বলেন, এগুলাে নিয়ে এখন কথা বলতে চাই না। এসব   ভয়া কথা, মিথ্যা কথা। সব ভয়া, এগুলাে সব ক্রিয়েট করা। এগুলাের মধ্যে যাইয়েন না।’ সুমিত্রা রানীর সুমিত্রা রানী দের জমির বৈধ কাগজ রয়েছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি  ব্যস্ত আছেন, এখন কথা বলতে পারবেন না বলে। ফোনের সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

তবে কাগজপত্র দেখে নডিয়ার ঘডিষার ইউনিয়ন ভমি সহকারী কর্মকর্তা ফরহাদ হােসেন মােল্যা প্রথম  আলােকে বলেন, সিকদার পরিবারের বাগানবাড়ির  ভেতরে  যে বাড়ি রয়েছে, তা তাঁর দুই ভাই রতন কমার দে ও জগদীস চন্দ্র দের নামে রেকর্ড হয়েছে। রেকর্ড অনুযায়ী তাঁরা ওই জমির মালিক।  ১৪২৫ বাংলা সাল খ্রিষ্টীয় ২০১৯ সাল) পর্যন্ত তাঁদের পরিশােধ করা রয়েছে।

 ভক্তভােগী পরিবারের সদস্যরা বলেন, সুমিত্রার বাবা।  অমূল্য চরণ দে ৭৯ নম্বর ডিঙ্গামানিক মৌজার ৮৫৯  নম্বর এসএ খতিয়ানে ৪১ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন। তাঁর মৃত্যর পর বিআরএস জরিপে ৭৬৫। খতিয়ানে রতন কুমার দে ও জগদীস চন্দ্র দের নামে।  ওই জমি রেকর্ড হয়। দুটি টিনের ঘরে পরিবারটি বসবাস করত। রতন কুমার দে ২০০৯ সালে ও তাঁর স্ত্রী ঝর্না রানী দে ২০১৩ সালে তিন মেয়েশিশু রেখে মারা যান। এরপর সুমিত্রা ও তাঁর ভাই জগদীস দে ওই শিশুদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। জগদীস দে। ২০২০ সালে মারা যান। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থাকায় ও বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ায় ওই তিন মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন সুমিত্রা। আশ্রয় নেন পাশের ডিঙ্গামানিক গ্রামের এক পরিত্যক্ত রান্নাঘরে। শনিবার ডিঙ্গামানিক গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গােলার বাজার-কার্তিকপুর সড়কের পাশে কাদির শেখের। বাড়ির রান্নাঘরে বসবাস করছেন সুমিত্রারা। ছােট্ট ওই ঘরেই একটি চৌকিতে থাকতে হয় চারজনকে।পরিবারে কোনাে পুরুষ সদস্য নেই। 

সুমিত্রা রানী দে বলেন, তিন শিশু কন্যা রেখে ভাই মারা যাওয়ার পরে কিছুটা বিপাকে পড়েন। এরপর সিকদারের পরিবার বাগানবাড়ি নির্মাণ শুরু করলে বসতভিটা ছেড়ে দেওয়ার জন্য নানাভাবে চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তাঁদের জমি দখল করে পারিবারিক শ্মশানের ওপর স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। চতুর্দিক দিয়ে প্রাচীর দিয়ে তাঁদের বাড়ি আটকে দেওয়া হয়।  

জয়নুল হক সিকদারের পরিবারের বাগানবাড়ি নির্মাণ করতে নির্মাণ করতে এই বাড়ির বাসিন্দাদের উচেছদ করা হয়েছে। দখল করে নেওয়া হয়েছে তাঁদের জমি। সম্প্রতি তােলা

ছবিপ্রথম আলাে

জানতে চাইলে বাগানবাড়ির ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সানােয়ার হােসেন প্রথম আলাের কাছে দাবি করেন, সুমিত্রা রানী ওই বাড়ির কোনাে বৈধ কাগজ দেখাতে পারেননি। তাই তাঁদের বিষয়টি সমাধান করা যায়নি।আর তাঁদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়নি। তাঁরা এমনিই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের বাড়ির ভেতরে দুটি ঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।

সুমিত্রার ভাইয়ের মেয়ে রুপা রানী দে (২১) প্রথম আলােকে বলেন, ‘আমার পিসি (ফুফু) ও আমরা  তিনটি বােন অর্ধাহারে-অনাহারে, নিরাপত্তাহীন অবস্থায় অসহায়ের মতাে জীবন যাপন করছি। আমরা চাই পৈতৃক ভিটা ফিরে পেতে।’ রুপা জানান, সম্প্রতি স্থানীয় সাংসদ ও উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল  হক তাঁদের খোঁজ নিতে এসেছিলেন। তিনি আর্থিক সহায়তা করেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন বসতভিটা ফিরে পেতে সহায়তা করার।

সুমিত্রা রানী বলেন, এখন আমাদের একটাই চাওয়া, পৈতৃক ভিটা ও এতিমতিন কন্যার পৈতৃক বাড়িফিরে পাওয়া। নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন সিকদার পরিবারের কাছ থেকে আমাদের পৈতৃক ভিটা ফিরিয়ে দিন। 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *